হতবাক

বুঝে না বুঝে মায়ের বইগুলি সে গোগ্রাসে গিলতে শুরু করলো

চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর আজকাল সে চুপচাপ থাকে। জনসংযোগ দূরে থাক, সামান্য আলাপচারিতাতেও অনাসক্তি। অথচ চারপাশে যা ঘটছে তা দেখে ভয়ানক বিরক্তি এবং কখনো কখনো ক্রোধের সঞ্চার হয়। মনে হয়, না, আর চুপ করে থাকা নয়, এবার একটা প্রতিবাদ খাড়া করা দরকার। কিন্তু মনের মধ্যে এক ভীরু মানুষ বাস করে। সে বলে, বাঁচতে চাও তো ঘাপটি মেরে বসে থাক। অগত্যা সে ঠিক করেছে যেখানে যতটুকু না বললেই নয়, সেখানেই থেমে যাও। উচিৎ-অনুচিত বোধের কণ্ঠরোধ করে নিশ্চুপ বসে থাক। তার অবসর জীবন এভাবেই স্বল্প শব্দ ব্যয়ে বেশ চলছিল। তবে ভিতরে ভিতরে একটা লড়াই চলে। ভাল মন্দ নিয়ে নিজস্ব মত আমি কাউকে বলতে পারবো না, এ কেমন কথা। কিন্তু কিছু কিছু এমন অবাক করা ঘটনা ঘটে যে বোধ-উপলব্ধি লুপ্ত হয়, অন্তত কিছু মুহূর্তের জন্য। বিস্ময়ে কথা সরে না। এমনিতেই হতবাক হতে হয়। শব্দ সংযমের আর প্রয়োজন হয় না। ব্যাপারটা তাকে সম্যক বুঝিয়ে দিল সেদিন দুটি বাচ্চা মেয়ে। তাদের কথা শুনে সে নির্বাক।

কত বয়স হবে মেয়ে দুটির। মেরে কেটে দশ। সন্ধ্যাবেলায় আবাসন ক্যাম্পাসের মাঠ থেকে ব্যাডমিন্টন খেলে ফিরছিল। হাতে র‍্যাকেট দুলিয়ে। এইসময় সে সান্ধ্যভ্রমণে বেরোয়। মেয়েদুটি আগে আগে হাঁটছে। এইবয়সের বাচ্চাদের খুব ভাল লাগে তার। ঝর্ণার মত কলকল করছে। কত কথা তাদের। হিসেব করে খরচ করতে হয় না। কথা বলছে তারা। এখন নিশ্চয় মন খারাপ। বাড়ি গিয়ে পড়তে বসতে হবে। বাড়ি ফেরার তাই তাড়া নেই। তারা আস্তে আস্তে হাঁটে। সে যখন মেয়েদুটির একটু পিছনে, তখন কান পাতে। নিছক কৌতূহল। কি বলছে ওরা। পূজোয় পাওয়া নতুন জামা কেমন হয়েছে, না কি বাড়িতে পুষি বেড়ালটা কিছু খাচ্ছে না, তার কথা। সে আজকাল চোখে একটু কম দেখে। কিন্তু শ্রবণশক্তি অটুট। কি গল্প করছিল তারা?

  • তু ও পিকচার দেখা – বাজিরাও মস্তানি?
  • হাঁ, দেখা
  • ক্যায়সা লাগা?
  • ঠিইইক হাঁয়
  • কিঁউ, অচ্ছা নহি লাগা? তুঝে স্টোরি মালুম থা, ক্যায়া? মুঝে তো বহুত আচ্ছা লাগা।

তু ও পিকচার দেখা – বাজিরাও মস্তানি?

তু ও পিকচার দেখা – বাজিরাও মস্তানি?

তাকে দেখতে পেয়ে মেয়েদুটি বলে, গুড ইভনিং আঙ্কল। কিন্তু সে হতবাক। বাজিরাও মস্তানির ধাক্কা তখনো সামলে উঠতে পারে নি। ঘটনাক্রমে, তার কিছুদিন আগে এই ছবিটি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনি সাজানো। মারাঠা পেশোয়া বাজিরাও। শৌর্যে বীর্যে বিখ্যাত। সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। কিন্তু মুখ্য নায়িকা মস্তানির বীরত্ব, শরীরি আকর্ষণ আর বাজিরাওর প্রতি অদম্য ভালবাসা, বাজিরাওর সংসারের দড়িদড়া ছিঁড়ে দিল। বাজিরাও ভেসে গেলেন এক অপ্রতিরোধ্য ভালবাসার জোয়ারে। দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে মেনে নিলেন মস্তানিকে। জমজমাট কাহিনী, বাস্তবনিষ্ঠ দৃশ্যপট, উজ্জ্বল অভিনয়, উন্নত সিনেমাটোগ্রাফি, মানে বাণিজ্যিকভাবে সফল হওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন সবই আছে এই ছবিতে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যা দর্শকের চোখ টানবে তা হল বাজিরাও ও মস্তানির শরীরি ভাষা, ওদের প্রেমের তীব্র যৌনতা ও আশ্লেষ। সে ভেবে পায় না বাচ্চা মেয়ে দুটি কি দেখল এই ছবিতে। কি দেখে বলল, মুঝে তো বহুত আচ্ছা লাগা, বা ঠিক হাঁয়। মস্তানি যে দৃশ্যে প্রসব বেদনায় পশুর মত চিৎকার করছে, কি দেখেছিল বা বুঝেছিল ওরা?

তার মনের ভিতরে একটা সুখের অলিন্দ আছে। যখন মন খারাপ থাকে, কিংবা মনের কথা কাউকে বলতে পারে না, তখন সে এই অলিন্দে এসে দাঁড়ায়। মা’র সঙ্গে কথা বলে। মা চলে গেছেন বহুদিন। কিন্তু মা ঠিক বুঝে এই অলিন্দে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে জিগ্যেস করেন, কি হয়েছে? মা’র সঙ্গে তার সখ্য জ্ঞান বয়স থেকে। মা তার হাত ধরে জীবনে আনন্দের উৎস চিনিয়েছেন। ভাষা ও সাহিত্যের পাঠ তো মা'র কাছেই। মা’র নিজস্ব সংগ্রহে ছিল রবি ঠাকুরের চয়নিকা। সে তখন খুব ছোট। মা চয়নিকা থেকে কবিতা পড়ে শোনাতেন। তার প্রিয় কবিতা ছিল ‘বন্দী বীর’। মা পড়তেন, “সভা হল নিস্তব্ধ, বন্দার দেহ ছিঁড়িল ঘাতক …”, সে কেঁদে ফেলত। মা’র হাত জড়িয়ে বলতো, “না মা, আর পড়ো না।” আবার দুদিন বাদেই মা'র কাছে আবদার, “‘বন্দী বীর’ পড়ো।” স্কুলের একটু উঁচু ক্লাসে ওঠার পর মা হাতে তুলে দিলেন বঙ্কিম রচনাবলী। সে রুদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেলল রাজসিংহ, দুর্গেশনন্দিনী, আনন্দমঠ, বিষবৃক্ষ। মা চাকরি নিলেন একটি প্রাইমারি স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হয়ে। প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হয়ে বিএ পাশ করলেন। পরের বছরই বাংলা স্পেশাল অনার্স পরীক্ষা সসম্মানে উত্তীর্ণ হলেন। সে সময় তাকে কে পায়। বুঝে না বুঝে মা’র বইগুলি সে গোগ্রাসে গিলতে শুরু করলো। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী, শেষের কবিতা, পুনশ্চ, শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ, ষোড়শী, প্রমথনাথ বিশীর কেরি সাহেবের মুন্সী, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের নীলাঙ্গুরীয়। সে যখন একা বাড়িতে, ঘরের ঠান্ডা লাল মেঝেতে গাল পেতে শুয়ে সে অপেক্ষা করতো, মা কখন আসবেন।

বুঝে না বুঝে মায়ের বইগুলি সে গোগ্রাসে গিলতে শুরু করলো

বুঝে না বুঝে মা’র বইগুলি সে গোগ্রাসে গিলতে শুরু করলো

আজ রাত্রে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর মা এলেন অলিন্দে। জিগ্যেস করলেন, "কি হয়েছে, তোর চোখমুখ এমন কেন?" সে সন্ধ্যাবেলার ‘বাজিরাও মস্তানি’ ইতিবৃত্ত বললো মাকে। মা প্রশ্ন করলেন,

  • তুই আবার কিছু বলিস নি তো ওদের?
  • না, মা, আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ওই টুকু টুকু মেয়ে! ওরা ‘পথের পাঁচালি’, ‘কাবুলিওয়ালা’ বা ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ নিয়ে আলোচনা করে নি। ওরা ‘বাজিরাও মস্তানি’ দেখেছে। শুধু দেখে নি, বেশ বোদ্ধাদের মত কথা বলছে। ওরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মা।
  • একটা কথা বলি। এযুগে বাচ্চাদের বয়ঃসন্ধি তাড়াতাড়ি হয়। ওরা এখন বয়সের তুলনায় অনেক কিছু বেশী জানে।

মাথা নীচু করে সে বলে, “পরিণত বয়সে কোন কিছুতেই অবাক হতে নেই?” তার মাথায় হাত বুলিয়ে মা সান্ত্বনা দেন, “তা কেন, জীবনের কোন বাঁকে কি চমক অপেক্ষা করছে তা তো আমদের জানা নেই। তাই তো বেঁচে থাকাটা এত রোমাঞ্চকর। আর অবাক হওয়া? সে সব বয়সেই হই আমরা। কেন, আমার পরিণত বয়সে হতবাক হওয়ার দু একটা ঘটনা তোকে বলি নি?”

মা তখন একটি প্রাইমারি স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা। ক্লাস ওয়ানের যিনি ক্লাস টিচার তিনি হন্তদন্ত হয়ে এলেন মা’র কাছে। হাতে একটি পরীক্ষার উত্তরপত্র।

  • দেখুন বড়দি কি কাণ্ড!
  • কেন, কি হয়েছে?
  • প্রশ্ন ছিল, পিতার নাম কি। আমি সবাইকে শিখিয়েছি, লিখবে, রাম বসু। ব্যাস, ছোট্ট সহজ নাম, ভুল করার কোন সুযোগ নেই।
  • সে কি! এ প্রশ্নের উদ্দেশ্য তো দেখা যে বাচ্চারা নির্ভুল ভাবে বাবার নাম লিখতে পারে কি না।
  • তা বললে কি হয় বড়দি? একেকজনের বাবার নাম অকূলকাণ্ডারি, বা হৃষীকেশ। তাদের ওপর চাপটা ভাবুন। বানান ভুল লিখে নম্বরটা খোয়াবে।
  • তুমি বাচ্চাদের বাবার নাম শুদ্ধভাবে লেখা না শিখিয়ে, কিভাবে নম্বর পেতে হয় তাই শেখালে? সে যাক, এখন তোমার সমস্যা টা কি?
  • দেখুন, আমাদের স্কুল সেক্রেটারির ছেলে তার বাবার নাম কি লিখেছে।

মা দেখলেন, আঁকাবাঁকা অপটু হস্তাক্ষরে লেখা “ছেকেটারি”। হতবাক হয়ে মা উত্তরপত্রটি ফেরত দিলেন টিচারের হাতে। এ কাহিনী শুনে সে প্রথমে হেসে খুন। তারপর জিগ্যেস করে মাকে, “তুমি কিছু বললে না? ছেলেটিকে ডেকেও কিছু জিগ্যেস করলে না?” মা বললেন, “আমি বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম। কেন জানিস? ঐ অদ্ভুত উত্তর দেখে নয়। আমার মনে হল ওই বাচ্চা ছেলে একটা বার্তা পাঠিয়েছে পরীক্ষকের কাছে – কার খাতা দেখছো, মনে থাকে যেন।”

মা'র হতবাক হওয়ার আরেকটি যে কাহিনী সে মা'র মুখে শুনেছিল তা মা'র বাংলা স্পেশাল অনার্স পরীক্ষা কেন্দ্র করে। সেসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু ছিল বাংলা স্পেশাল অনার্স পরীক্ষা। যাঁরা কোন বিষয়ে অনার্স ছাড়া সাধারণভাবে বিএ পাশ করেছেন, তাঁদের জন্য এই সুযোগ। স্কুলের বহু শিক্ষক তাঁদের চাকুরিগত সুবিধা বা শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়ানোর জন্য এই স্পেশাল অনার্স পরীক্ষা দিতেন। এঁরা বোধহয় সকলেই প্রাইভেট পরীক্ষার্থী, কলেজের নিয়মিত পঠনপাঠন থেকে বেশ কিছুদিন সম্পর্কশূন্য। মা’র সিট পড়েছিল বঙ্গবাসী কলেজে। একদিন, তখন পরীক্ষা চলছে, মা শুনতে পেলেন, পুরুষকণ্ঠ, খুব আস্তে, “দিদি, দিদি, এক মিনিট শুনবেন?” শব্দের উৎস খুঁজে মা তাকালেন পাশে। এক মাঝবয়সী পরীক্ষার্থী কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে, “দিদি, একটা জিনিস প্লিজ বলুন না দিদি।“ মা ইতস্তত করছেন, উচিত-অনুচিতের দোলায়। তিনি তখন বেপরোয়া, “দিদি, ‘শেষের কবিতা’ কবিতা না উপন্যাস?” মা বললেন, “উপন্যাস”। তিনি একগাল হেসে, “দিদি আর শুধু নায়ক-নায়িকার নামদুটো বলে দিন।” মা তা বলতেই, তিনি আবারও বিস্তৃত হেসে বললেন,“ব্যস দিদি, আর কিছুর দরকার নেই।" ঘাড় গুঁজে লিখতে শুরু করলেন। একটা দীর্ঘ বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন ছিল সেটি। মা একটু অবাক হলেন, সেইসঙ্গে নিশ্চিন্ত, বিরক্তির হাত থেকে মুক্ত হয়ে। তবে গল্পের তখনও কিছুটা বাকী ছিল। পরীক্ষা শেষ হলে, সেই ভদ্রলোক মা’র কাছে এসে বললেন, “বাঁচালেন দিদি। বুঝতেই পারছেন, একটা স্কুলে প্রাইমারী সেকশনে পড়াই। এইসব ব্যাপারে চর্চা নেই তেমন। স্পেশাল অনার্সটা হয়ে গেলে উঁচু ক্লাসে বাংলা পড়াতে পারবো, আর মাইনেটাও একটু বাড়বে।“ মা হাসলেন। যাওয়ার আগে আবার ধন্যবাদ দিয়ে তিনি বললেন, “ঐ ‘শেষের কবিতা’ প্রশ্নে একটু আটকে গেছিলাম। তারপর আপনার হেল্প পেয়ে ঝাড়া তিন পাতা লিখেছি”। আত্মতৃপ্তির হাসি চোখেমুখে উপচে পড়ছে। মা’র কাছে এই অবধি শুনে সে লাফ দিয়ে উঠেছিল, “মানে? ওইটুকু জেনে, বইটা না পড়ে, তিন পাতা লেখা! তুমি অবাক হও নি?” মা বলেছিলেন, “বিস্ময়ে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কেন জানিস? উনি কি লিখেছেন তা ভেবে নয়। আমি হতবাক হয়েছিলাম, স্পেশাল অনার্স পাশ করলে উনি উঁচু ক্লাসে কি পড়াবেন সে কথা চিন্তা করে।”

মা সহজে অবাক হতেন না। পরিমিত ও পরিণত বোধ ছিল তাঁর। কিন্তু তার মুখে শোনা এক ঘটনা শুনে মা নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন। সে ঘটনা তার মনেও এমন গভীর দাগ কেটেছিল যে তা এখনও মেলায় নি। তখন কলেজের সেকেন্ড ইয়ার। নাগেরবাজারে একটা আড্ডার ঠেকে সে প্রায়ই যেত। এক বন্ধুর ফোটো স্টুডিয়োর দোকান। স্টুডিয়োর সামনে একটা গাছের নীচে বেদীমত বাঁধানো। ওখানেই সন্ধ্যায় আড্ডা জমতো। চা, চারমিনার আর হৈ চৈ। মাঝে মাঝে যশোর রোড ধরে দু এক প্রস্থ হাঁটা। তখন এত গাড়ি ছিল না রাস্তায়। আড্ডার মেজাজে পথ চলা যেত। একদিন তারা কয়েকজন বন্ধু মিলে মৃণালিনী সিনেমা হল অবধি এসে আবার যশোর রোড ধরে হেঁটে ফিরছে নাগেরবাজারের দিকে। এক বন্ধুর পকেটে সেদিন টুইশন থেকে পাওয়া কড়কড়ে নোট। তাই চারমিনারের বদলে গোল্ডফ্লেক। হাওয়া ও মেজাজ দুটোই ফুরফুরে। ওরা সরোজিনী নাইডু কলেজের সামনে তখন। একটা ট্যাক্সি ওদের অতিক্রম করে যাচ্ছে। অল্প গতিতে। ট্যাক্সির ভিতর থেকে চিৎকার ও ধস্তাধস্তির আওয়াজ পেল ওরা। ট্যাক্সিটা এগিয়ে যাচ্ছে। ওরা সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে। ট্যাক্সিটা ওদের ছাড়িয়ে গজ পঞ্চাশেক এগিয়েছে, ওরা দেখে ট্যাক্সি থেকে কাউকে যেন রাস্তায় ফেলে দেওয়া হল। তারপরেই দ্রুতগতিতে বেড়িয়ে গেল সে ট্যাক্সি। মিনিট দুয়েক পরেই ওরা অকুস্থলে পৌঁছে দেখে একটি লোক রাস্তার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। রাস্তায় আধো আলো আধো অন্ধকার। মাঝবয়সী, ধুতি শার্ট পরা, নিম্নবিত্ত চেহারা। লোকটি বেঁচে আছে। ঘড়ঘড় গোঙানির আওয়াজ। বুক বা পেট থেকে রক্ত বেরিয়ে রাস্তার ধুলোয় মিশছে। নাক মুখ রাস্তার ওপর। মাথাটা ওঠানোর চেষ্টা করছে। কাছাকাছি কেউ নেই। ওরা সকলেই হতবুদ্ধি। এমন সময় ওদের মধ্যে কে যেন বললো, “কেটে পড়, ফালতু ঝামেলায় পড়বো”। এ যেন সকলের মনের কথা ছিল। মুহূর্তের মধ্যে ওরা হাঁটা লাগালো। যত দ্রুত সম্ভব। পিছনে রাস্তার ওপর লোকটি তখন যুঝে যাচ্ছে। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা।

অকুস্থলে পৌঁছে দেখে একটি লোক রাস্তার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে

অকুস্থলে পৌঁছে দেখে একটি লোক রাস্তার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে

সেদিন বাড়ি ফিরে ভারাক্রান্ত মনে সে মাকে ঘটনাটি বলে। সিগারেট খাওয়ার প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে। মা সবটুকু শুনে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। একটি কথাও বলেন নি। কি ছিল মা’র চোখে? অজানা মানুষের জন্য কষ্ট? নিষ্ঠুর ঘটনার জন্য ক্ষোভ ও ঘৃণা? না কি তার জন্য ভর্ৎসনা? সে মা’র কোলে মুখ রেখে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল। মা কিন্তু নির্বাক ছিলেন। এর পরেও মা কখনো এই ঘটনা প্রসঙ্গে একটি কথাও বলেন নি।

আজ এত বছর বাদে রাত্রে অলিন্দে মা’র পাশে দাঁড়িয়ে সেই ঘটনার কথা মনে পড়লো। রাত্রির নিঃশব্দ ভাষায় সে মাকে জিগ্যেস করে, “মা, মনে আছে তোমার, সেই যে তোমাকে বলেছিলাম? বহু বছর আগে, আমরা বন্ধুরা যশোর রোড ধরে হাঁটছিলাম। একটি লোককে মারাত্মক জখম করে ট্যাক্সি থেকে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল। দুষ্কৃতিরা ট্যাক্সিতে পালায়। আমরা দেখি যে লোকটি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে”। এটুকু বলতেই মা তার হাত চেপে ধরলেন। মা'র চোখের দিকে তাকিয়ে সে আবিস্কার করে সেই পুরনো দৃষ্টি। সেই বহুযুগ আগে যেদিন সে মাকে ঘটনাটি বলেছিল। সেদিনের দৃষ্টি। চিনে নিতে ভুল হয় না তার। আনমনে মাথা নীচু হয়। আজ আকাশে অনেক তারার আলো। এই তারাগুলোই ছিল সেদিন? লোকটি বার বার মাথা উঁচু করে এই তারার আলোই ছুঁতে চাইছিল? না কি মাথায় জড়ো করছিল সহস্র অশ্বশক্তি, ব্যাথার বিস্ফোরণ কাটিয়ে ঘরে ফেরার জন্য? রেল লাইনের ধারে জবরদখল কলোনীতে একটা ছোট ঘরে হয়তো ওর স্ত্রী তখন ওর জন্য রান্না করছে। ওর মেয়ে ঘরের স্বল্প আলোয় দুলে দুলে পড়ছে পরের দিনের স্কুলের পড়া। ও কি ঘরে ফিরতে পেরেছিল?

মা’র দৃষ্টি এড়িয়ে সে বলে, “মা, আমার ভিতরে একটা ভীতু মানুষ বাস করে। কিন্তু সে বলশালী। সে আমাকে দাঁড়াতে দেয় নি সেদিন। আমরা পালিয়ে গিয়েছিলাম। লোকটি মারা গেল না বেঁচে গেছিল, জানি না। পরে খোঁজ নিতেও ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু মা, তুমি বিশ্বাস করো, ঈশ্বর না করুন, যদি এখন আমার সামনে সেই ঘটনা পুনরাবৃত্ত হয়, আমি পালাবো না। আমি তাকে ঘরে ফিরিয়ে…।" অবরুদ্ধ আবেগ তাকে কথা শেষ করতে দেয় নি। কিন্তু মা কি বিশ্বাস করলেন তার কথা? তা বোঝার তাগিদে মা’র দিকে তাকায় সে। কিন্তু মাকে দেখতে পায় না। মা কখন অন্তর্হিত হয়েছেন সে জানে না। সুখের অলিন্দে সে একা।


অঙ্কনঃ সুকন্যা বসু রায় চৌধুরী